রোজা একটি ফার্সি শব্দ যার আরবি সিয়াম।
সুবহে সাদেক বা ফজরের শুরু থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রোযার নিয়তে পানাহার, পাপাচার, কামাচার এবং সেই সাথে যাবতীয় ভোগ-বিলাস থেকেও বিরত থাকাকে শরীয়তের পরিভাষায় রোযা বলে।
রোযা মোট চার প্রকার :
রমযান মাসের রোযা এবং রমযানের রোযার কাযা ও কাফফারার রোযা ফরয।
মান্নতের রোযা ওয়াজিব।
আশুরা বা মহররমের ১০ তারিখের রোযা, শাওয়ালের ছয় রোযা, শবে বরাতের রোযা, শবে কদরে রোযা নফল।
হাদীস শরীফে রোযার অনেক সওয়াব বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তা'আলার নিকট রোযার মর্তব্য অতি বড়। রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলছেন, যে ব্যক্তি রমযান শরীফের রোযা ঈমানের সঙ্গে শুধু আল্লাহ্র সন্তুষ্টি এবং আখেরাতের সওয়াব লাভের আশায় রাখবে, তার পূর্ববর্তী সমস্ত (ছগীরা) গোনাহ্ মা'ফ হয়ে যাবে।
রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রোযাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহ্র নিকট মেশক আম্বরের খোশবু অপেক্ষা অধিক প্রিয়। কিয়ামতের দিন রোযার অসীম সওয়াব পাওয়া যাবে।
রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন অন্যান্য লোক যখন হিসাব-নিকাশের কঠোরতায় আবদ্ধ থাকবে, তখন রোযাদারের জন্য আরশের ছায়ায় দস্তরখানা বিছান হবে।
তারা আনন্দের সাথে খাওয়া দাওয়া করতে থাকবে।
নিসরা আশ্চর্য হয়ে বলবে, এ কি ব্যাপার! তারা সানন্দে পানাহার করছ, আর আমরা এখনও হিসাবের দায়ে আবদ্ধ আছি!
উত্তরে বলা হবে : দুনিয়াতে তোমরা যখন সানন্দে পানাহার করেছিলে, তখন তারা আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে রোযা রেখে ক্ষুদা ও পিপাসার যন্ত্রণা সহ্য করেছিল। রোযা ইসলামের বড় একটি রোকন। যে রমযানের রোযা না রাখবে, সে বড়ই গোনাহগার হবে এবং তার ঈমান কমজোর হয়ে যাবে।
রমযান শরীফের রোযা পাগল ও না-বালেগ ব্যতীত (স্ত্রী-পুরুষ, ধনী- দরিদ্র, অন্ধ, বধির, শ্রমিক) সকলের উপর ফরয। শরীয়তে বর্ণিত রমযান শরীফের রোযা না রাখা কারও জন্য দূরুস্ত নয়। এভাবে যদি কেউ রোযার মানত করে, তবে সে রোযাও তার উপর ফরয হয়ে যায়।
রোযার জন্য যেমন খাওয়া দাওয়া পরিত্যাগ করা ফরয, নিয়্যত করাও ফরয, কিন্তু নিয়্যত মুখে পড়া ফরয নয়, শুধু যদি মনে মনে চিন্তা করে সঙ্কল্প করে যে, আমি আজ আল্লাহ্র নামে রোযা রাখব এবং কিছু পানাহার করব না।
তবে রোযা হয়ে যাবে। কিন্তু যদি কেউ মনের চিন্তা এবং সঙ্কল্পের সাথে মুখে ও বাংলায় বা আরবীতে নিয়্যত পড়ে যেমন বলে, ‘আমি আল্লাহ্র নামে রোযার নিয়্যত করছি' তবে তাও ভাল । আরবী নিয়ত যেমন - اللَّهُمَّ لَكَ صُمتُ
রোজা ভঙ্গ ও রোযা মাকরূহ হওয়ার কারণ
রোযা রেখে হঠাৎ যদি এমন কোন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে যে, কিছু খাওয়া-পানি না করলে মরণের আশঙ্কা হতে পারে বা রোগ অত্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, তবে এইরূপ অবস্থায় রোযা ছেড়ে দিয়ে ঔষধ সেবন করা জায়েয আছে।
যেমন, হঠাৎ পেটে এমন বেদনা উঠল যে, একেবারে অস্থির হয়ে পড়ল, অথবা সাপে দংশন করল যে, ঔষধ না খেলে জীবনের আশা ত্যাগ করতে হয়, এরূপে যদি এমন ভীষণ পিপাসা হয় যে, প্রাণনাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে।
গর্ভবতী মেয়েলোকের যদি এমন অবস্থা হয় যে, নিজের বা সন্তানেরপ্রাণ নাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ভাঙ্গা জায়েয আছে। কোন পরিশ্রমের কারণে যদি এত পিপাসা হয় যে, প্রাণ নাশের আশংকা হয়, তবে রোযা ছেড়ে দেওয়া জায়েয আছে।
কেউ যদি এমন রোগাক্রান্ত হয় যে, যদি সে রোযা রাখে, তবে রোগবেড়ে যাবে, রোগ দূরারোগ্য হয়ে যাবে, জীবন হারাবার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু শুধু নিজের কাল্পনিক খেয়ালে রোযা ছাড়া জায়েয নয়, যখন কোন মুসলমান দ্বীনদার চিকিৎসক সাক্ষ্য দিবেন যে, রোযা তোমার ক্ষতি করবে, তখন রোযা ছাড়া জায়েয হবে।
যদি ওই চিকিৎসক, ডাক্তার বা কবিরাজ যদি কাফের (অমুসলমান) হয়, অথবা এমন মুসলমান হয় যে, দ্বীন-ঈমানের পরওয়া রাখে না, তবে তার কথায় রোযা ছাড়া যাবে না।
যদি নিজে ভুক্তভোগী জ্ঞানী না হয়, তবে শুধু কাল্পনিক খেয়ালের কোনই মূল্য নাই। কাল্পনিক খেয়ালের বশীভূত হয়ে কিছুতেই রোযা ছাড়বে না। এইরূপ অবস্থায় দ্বীনদার চিকিৎসকের সাক্ষ্য (সনদ) ব্যতিরেকে রোযা ছাড়লে কাফ্ফারা দিতে হবে ।
রোযা না রাখলে গোনাহ্ হবে।
রোগ থেকে আরোগ্য হওয়ার পর যে দুর্বলতা থাকে, সেই দুর্বল অবস্থায় রোযা রাখলে যদি পুনরায় রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রবল আশংকা থাকে, তবে সে অবস্থায় রোযা না রাখা জায়েয আছে।
যে ব্যক্তি বাড়ী থেকে ৪৮ মাইল বা তদুর্ধ্ব দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার এরাদা করে নিজ বাসস্থানের লোকদের সীমা অতিক্রম করেছে, তাকে শরীয়তের পরিভাষায় 'মুসাফির' বলে। যারা শরীয়ত অনুসারে মুসাফির তারা সফরে থাকাকালীন রোযা ছেড়ে দিয়ে অন্য সময় রোযা রাখতে পারবে।
সফরে যদি কোন কষ্ট না হয়, যেমন গাড়ীতে ভ্রমণ করছে, ধারণা এই যে, সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ী পৌঁছে যাবে, কিংবা সাথে আরামের দ্রব্য আছে। তবে রোযা রাখাই উত্তম, কিন্তু না রাখলে গোনাহ্ হবে না; অবশ্য রমযানের ফযীলত পাবে না।
যদি কেউ পীড়িতাবস্থায় মারা যায়, অথবা শরয়ী সফরেই মৃত্যু হয়, তবে যে, কয়টি রোযা এই রোগের অথবা এই সফরের জন্য ছুটিয়াছে, আখেরাতে তার জন্য দায়ী হবে না। কেননা, সে কায়জা রোযা রাখার সময় পায় নাই ।
কেউ পীড়িতাবস্থায় ১০টি রোযা ছাড়ছে এবং পরে পাঁচ দিন ভাল থেকে মৃত্যু হল, এখন পাঁচটি রোযা মাফ পাবে, কিন্তু যে পাঁচ দিন ভাল ছিল অথচ ক্বাযা রোযা রাখে নাই, সেই পাঁচটি রোযার জন্য দায়ী হবে।
কিয়ামতের হিসাবের সময় তার জন্য ধর-পাকড় হবে । আর যদি রোগ আরোগ্য হওয়ার পর পূর্ণ দশ দিন ভাল থাকে, তবে পূর্ণ দশটি রোযার জন্যই দায়ী থাকবে।
বৎসরে পাঁচদিন রোযা রাখা হারাম।
(১) ঈদুল ফিতর বা রোযার ঈদের দিন (১ দিন)।
(২) কোরবাণীর ঈদের দিন ও তারপর তিন দিন (মোট ৪ দিন)।
উপসংসারে, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ্য বা খুঁটি গুলোর মধ্য তৃতীয় হচ্ছে রোজা বা সাউম। প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য রমযান মাসের প্রতি দিন রোজা রাখা ফরজ, যার অর্থ অবশ্য পালনীয়।